মাঝে মাঝে কিছু মানুষের কথা মনে পড়ে!

মানুষ এবং সভ্যতার তাল লয় একই। কেবল চলমান। নদীর মতো এতো নিবির বহমান তার ধারাবাহিকতা কোথায় যে কখন, কোন কূলে কি আঘাত-প্রতিঘাত পার করে এসেছে তা ভাবার সময়টুকুও পায় না। তবুও জীবনের কিছু নিয়ম থাকে মাঝে মাঝে স্মৃতি কাতর হতে হয়। মনে পড়ে সেসব দিন, সেসব মানুষের কথা। যারা একটা সময় খুব গভীর ভাবে আমাদেরই সাথে মিশে ছিলো। 

১. যেমন এই হঠাৎ আমার মনে পড়ে যাচ্ছে- উজ্জ্বল রৌদ্র দিনের কথা। স্কুলের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার একমাত্র জায়গা নানু বাড়ি। আমার নানা ভাই আপাদমস্তক একজন কৃষক। আমরা নানু বাড়িতে গেলে ভোর ভোর রওনা দিতাম। ১০ টা ১১ টার মধ্যে পৌঁছে যেতাম। নানা ভাই থাকতো জমিতে। তো কিছুক্ষণ পর বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে নানা ভাই আসতেন। সদ্য নদী থেকে গোসল করে আসা উরর্বর মাটি ও মেঘনার সন্তান আমার নানা ভাই এসেই আমাদের দেখে একটা হাসি দিতেন। সাদা অল্প কিছু দাঁড়ি, মাঝারি গড়নের ছিমছিমে দেহের একজন মাটির মানুষ। আমি আর তার মতো সহজ মানুষ দেখি নি। বাড়িতে এসে, উঠানে বসে প্রথমে সারা শরীরে সরিষার তেল মাখতেন। আমি পাশে বসে এটা ওটা জিজ্ঞাস করতাম আর দেখতাম। 

নানা ভাইয়ের কিছু অভ্যাস আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। ফজরের টাইমে উঠে টিউবওয়েল চেপে ওযু করার শব্দে বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে দিতেন। গ্রাম্য ছিমছিমে মসজিদে তার হাত ধরেই বহুবার গিয়েছি। সেই মসজিদ এখনো তেমনই আছে। স্পষ্ট মনে পড়ে- একদিন বলছিলাম, তোমাদের মসজিদে ফ্লোরে পাটি বিছানো কেন? আর ভাঙা কেন মসজিদ? নানা ভাই হাসতো। শহুরে চকচকে মসজিদ আর হৃদয়ের কাবারূপ গ্রাম্য মসজিদের পার্থক্য তখনো বুঝতাম না। 

সকালে নানা ভাইয়ের সাথে বাজারে যেতাম। নদীর পাড় ঘেষা গ্রাম্য বাজার। এমন কোন দিন হয়নি- যেদিন আমি নানা ভাইয়ের সাথে বাজারে গেছি কিন্তু তিনি আমাকে হালুয়া, পরোটা আর কাপ দই খাওয়াননি। ফসলের মৌসুমে তিনি দুপুরের ওয়াক্ত জমিতে পড়তেন। আমি অনেকবার দেখেছি ওয়াক্ত হয়ে গেলে তার গামছাটা শুকনো জমিতে বিছিয়ে তাতে নামাজ পড়তেন। নানু অনেক বকতো কেনো ওই টাইমে বাড়িতে চলে আসে না? নানা ভাইয়ের সাথে আমি নদীতে গোসল করতে যেতাম। সাতার শেখার সব রকমের ব্যার্থ প্রচেষ্টাও তার সাথেই। এমনকি নানা ভাই অসুস্থ হওয়ার আগের শেষ স্বাভাবিক গোসলটাও আমার সাথেই। এরপর মেঘনা পাড়ের ছেলে মেঘনাতেই শেষ গোসল করে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে আবার মেঘনার উর্বর মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। 

নানা ভাই নেই আজ অনেক বছর। আমি স্পষ্ট তার মুখায়ব, তার স্বর, তার শত শত নীতিকথা, উপদেশ কল্পনা করতে পারি। 

২. বড় মা (নানুর মা) কে স্বভাবতই আমি খুনখুনে অবস্থায় পেয়েছি। খুব মোটা ফ্রেমের চশমা পড়তেন। তবে তার হাতের রান্না এবং সকল প্রকার আপ্যায়ন খুব কাছ থেকেই পেয়েছি। আবহমান বাঙালির ক্লাসিক বসত বাড়ি বলতে যা বুঝায় বড় মা দের বাড়িটা ছিলো তেমন। সামনে বড় উঠোন, পেছনে ছনের রান্না ঘর, তার পেছনে বিশাল খাল। বড় মা দের বাড়িতে গেলে বেশি ভাগই ধরে আনা দেশি মাছের তরকারী থাকতো। পুরো বাড়ি আলোকময় হলেও ঘরের ভেতরটা কেন যেনো অন্ধকারই থাকতো। 

শেষবার বড় মা দের বাড়ি থেকে ফিরার সময় তার টলমলে চোখ স্পষ্ট আমার সামনে ভাসে। আমরা অনেকটা পথ চলে আসছিলাম। তারপর হটাৎ আম্মু হাতে একশ টাকা দিয়ে বললো-বড় মায়ের হাতে দিয়ে পান খেতে বল। আমি অনেকটা দূর থেকে দৌড়ে এসে- বড় মা কে দিলাম। বড় মা ভুলেও নিবেন না তাও বোধহয় আমার দিকে তাকিয়েই নিলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমার এখনো স্পষ্ট তার গলার স্বর মনে আছে। 

৩. আমার বড় মামা খুব ব্যক্তিত্ববান মানুষ ছিলেন। বেশ ভারী স্বভাবের এবং শান্ত মেজাজের। বাড়ির বড় নাতি হওয়ায় কারো কাছেই আদর কম পাইনি। তিনিও করতেন। প্রবাসী ছিলেন তাই একদম ছোট বেলাটা ওইভাবে পাই নি। তবে প্রাইমারী বয়সটায় পেয়েছি। 

প্রথম সাইকেল চালাতে শিখে একটা হেভী ডিউটির মাঝারি বয়সের ব্রেক ফেল সাইকেল নিয়ে রাস্তায় এলোপাথারি ঘুরতাম। একদিন মামা বললেন- আমারে একটু সামনে নিয়ে যা...আমি প্রথম বারের মতো ডাবল নিয়ে সাইকেল চালালাম। পুরো রাস্তা সাপের মতো একে বেকে চললাম। মামা এতো হাসলেন আর আইন করে দিলেন আমি যেনো মেইন রাস্তায় আর না চালাই। 

শেষবার আমি কলেজে যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠবো তখন মামার ফোন এলো। মামা আম্মুর কথা জিজ্ঞাস করলেন। আমি তখন মায়ের ফোন নিয়ে কলেজে যাই। এর কিছুদিন পরই মামা চলে গেলেন। আমার আজও সেই ট্রেন স্টেশনে পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই ট্রেনের বিকট সাউন্ড আর শত মানুষের কোলহলের মাঝে মামার নাম ধরে ডাকার স্বরটা মনে আছে। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। 

এমন আরো অনেকের কথাই মনে পড়ে। সরাসরি রক্তের সম্পর্ক কিংবা নিত্যান্তই আত্মীয়, পরাত্মীয় অথবা খুব সাধারণ কেউ কেউ। যারা ছোট্ট এই জীবনের বিশাল একটা সময় জুড়ে বিচরণ করেছে। এখনো ঘুরে বেড়ায় মনের আঙ্গিনায়। আমি বারবার তাদের কথা মনে করি। বার বার তাদের কাছে ফিরে যেতে চাই। ফিরে যাইও হয়তো ভ্রমে কিংবা ঘোরে। 

মন্তব্যসমূহ

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫