প্রতিটি জীবনের দগ্ধ সময়ের গল্প শারমিন আহমেদ এর উপন্যাস গ্রহণকাল।

বই : গ্রহণকাল 

চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সময়কাল কত? খুব বেশি কি? গ্রহণ চলাকালীন সময়টা আবহমান বাঙালির কেউ কেউ খুব মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করে, কেউ বা বাড়ির অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের কিছুটা সাবধান থাকতে বলেন। কিন্তু এই সামান্য সময়টুকু নিয়ে মানুষের ভাবনা যাই হোক চাঁদ বা সূর্যের জন্য তা কেমন? যত অল্প সময়ে চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণ শেষ হয়ে যায় তেমন দ্রুতই কি মানুষের জীবনের গ্রহণকাল কেটে যায়?

সমাজের খুব সাধারণ একটা রীতি বেঁচে থাকা। আমরা বেঁচে আছি, সমাজ সংসার ও সম্পর্কের অদৃশ্য সুতোয়। ভেতরে গ্রহণ নিয়ে হাসি মুখে মানিয়ে চলার নামই জীবন। পলিমরফিজমের মতো একজন মানুষের দ্বি সত্তার যে প্রকোপ তার কতটুক আমাদের জানা থাকে? পাশাপাশি থেকে, একই ছাদের নিচে বেড়ে উঠা বাবা-মায়ের ভেতরকার কথাই বা আমরা কতটা জানতে পারি? সমাজ সংসারের এমন নিয়মে আটকে পড়া ৩ টা পরিবারের সংমিশ্রণ ও বেঁচে থাকার যুদ্ধের বর্ণনা কথাসাহিত্যিক শারমিন আহমেদের এবারের উপন্যাস গ্রহণকাল।

গল্পের মূল ভিত্তি তিনটি পরিবারের উপর। গল্পের প্লট শুরু হয় অসুস্থ শামসাদ বেগমের পৌঢ়খাওয়া বাড়ি থেকে। স্বামীর উপর তীব্র ঘৃণা ও দীর্ঘ সংসার জীবনের হেরে যাওয়া যাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অচল করে দেয়। তাদের সন্তান ইরফান ও ইশিতার ব্যাক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনে শুরু হয় মূল গল্পের ভিত্তি। এছাড়া আছে মনিরা-মামুন দম্পতি, রাশেদ-অতসী ও ইরফানের বন্ধু রঞ্জুর পরিবার।

একজন মানুষ ও তাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা কতটা নির্ভরশীল তার উপর এবং তার আশেপাশে তার প্রভাব কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার এক স্পষ্ট উদাহরণ গ্রহণকাল। প্রতিটা সংসারে মিশে আছে এ সত্য। আমরা যাকে বাবা হিসাবে চিনি তারও অতীত থাকে, যাকে মা হিসেবে জানি তারও হয়তো রয়ে গেছে কিছু কূটকৌশল। স্বাধীনমনা দূরন্তর কিশোরেরও থাকে কিছু অভিমান। বাবা ও মায়ের প্রতিযোগিতামূলক ভালোবাসার মাঝেও অবুঝ শিশু হয়তো বুঝে নেয় সত্যিকার মমতা ও অভিনয়। ভালোবাসি বলেই ভালোবাসা যায় না কিংবা মোহ কাটিয়ে ফিরে আসা যায় না এমন সত্যও জানা যায় ছোট্ট এই মানব জীবনে। আমাদের চারদিকে নয় আমাদের সাথেই নিত্য ঘটে চলেছে এমন। লেখিকা আমাদের অগোচরে আমাদেরই গল্পগুলো চুরি করে তিনটে পরিবারে অন্তর্জালে আটকে দিয়েছেন গ্রহণকাল নামে।

গ্রহণকাল কোন সাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত বা কৌতুহলী গল্প নয়। এর শুরু ও শেষ বলতে কিছু নেই। এ গল্প অতি সাধারণ মানব জীবনের গল্প। যে গল্প কখনোই বলার প্রয়োজন হয়ে উঠে না, যে গল্প কেবল অনুভবের।

সংসার জীবনে আটকে পড়া প্রতিটা মানুষের গল্প এটি। অতি চটপটে রষকষে প্রেমের গল্প নয় কিন্তু এর গল্পে আছে সমাজের ঝাঁঝালো সত্য। বেঁচে থাকার জীবন ও অভিনয়ের জীবনের পার্থক্য নিজে ব্যাতিত আর কি কেউ তফাৎ করতে পেরেছে কখনো? ছোট্ট এই মানব জীবন যেনো পুরোটাই এক মস্ত গ্রহণকাল যার কোন অন্ত নেই, যার গ্রহণ থেকে বেড়িয়ে আসার কোন সুযোগ নেই।

মন্তব্যসমূহ

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫