সামাজিক জনরার এক নিউরও টক্সিন উপন্যাসদ্বয়।

প্রতিবার মেলা আসে, আসে শত শত নতুন বইয়ের ভিড়। কেনা তো দূরে থাক, সব তো আর পড়া কিংবা ছুঁয়ে দেখাও হয় না। অনেক রত্নই ঢাকা পড়ে রয়, কিছু কিছু আবার বেড়িয়েও আসে। যে সময়কালে চোখ মেললে কেবল- একই ছন্দময় প্রেম-বিরহ, কোলাহল, হত্যা আর ঘুম-খুনের থ্রিলারের ছড়াছড়ি সে সময় বসে এমন একটি উপন্যাস লিখতে পারা সত্যি অবাক করার মতো। আমার বৃদ্ধমূল ধারণা এখন এমন আর হয়তো লিখনেও না কেউ।  

মেলায় প্রথম দিন কিনেছিলাম 'জলমগ্নতার দহন' কিন্তু পরবর্তীতে জানলাম 'নাগরিক জলপত্র' এর প্রথম পর্ব। তাই সিকুয়েন্স ঠিক রেখেই পড়া শুরু করলাম।
'নাগরিক জলপত্র' এবং 'জলমগ্নতার দহন'  এ যাবতকালে আমার পড়া সবচেয়ে মুগ্ধকর এক সামাজিক উপন্যাস যুগল। শারমিন আহমেদ ম্যামের লেখায় সবসময় সমাজ ও সংসারের একদম ভেতরকার দৃশ্য উঠে আসে। গভীর ও নিখাদ সত্য গুলো এমন অকপটে বলে ফেলেন কিভাবে আমার জ্ঞান হয় না। 
আমরা সবাই সামাজিক দায়বদ্ধতার মাঝেই বেড়ে উঠি। সব কথাই কি সবসময় বলা যায়? সব দেখাই কি সব সময় মনে রাখা যায়? নাকি রাখতে হয়? দেখা-অদেখা ও উপলব্ধির সংমিশ্রণ আমাদের যে মিশেল সভ্যতা তা আমাদের বেড়ে তোলায় কতটুকুই বা স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পেরেছে? এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ-অসুখ বিন্যাসের এমন মিশ্রণ এই উপন্যাস যুগল; যা আপনার ঘরে বাইরে দেখা-অদেখা ও উপলব্ধি লব্ধ কথাগুলোকেই বারবার বলে যেনো।  

ছবিঃ নাগরিক জলপত্র এবং জলমগ্নতার দহন 

সমাজবদ্ধ জীবনে প্রতিবেশীর দিকে তাকিয়ে আমরা সকলেই বোধহয় নাভিশ্বাস ছাড়ি- 'আহা, ওরা কত্ত সুখী একটা পরিবার!' কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রতিবেশী তো দূরে থাক, আমরা কি পেরেছি আমাদের পরিবারের লোকদের ভেতরকার সম্পূর্ণ কথা জানতে? এমন'ই সব ধোঁয়াশাতুর চোখে আমাদের দেখা অদেখা নাগরিক জলজীবনের এক বিস্তৃত নাট্যমঞ্চ বলা যায়- 'নাগরিক জলপত্র' কে। 
একটি গোছালো সুন্দর পরিবার তছনছ হওয়া থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে দীর্ঘ ক্ষতি বুকে নিয়েই শীতল পদাচরণময় জীবন ফুটে ওঠেছে বইটিতে। বড় সন্তানের নামে যে পরিবার বা বাড়ি মানুষ চিনে; সে বাড়িই তার হঠাৎ অন্তর্ধানে ধীরে ধীরে কিভাবে নাম পাল্টে নেয়। একটি সংসার গঠন ও ভালোবাসার মুখোশে বছরক্লান্তি দূর্বোধ্য নিপীড়নের মুখেও কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়, কিভাবে স্বঘোষিত যুদ্ধে সবার অগোচরেই কেউ আত্নবলি দিয়ে শুষ্ক মনশশ্মান নিয়ে সবার ভালোর উদ্দেশ্যে ছুটে বেড়ানো যায়। সমাজের বিত্ত মাপের প্যারামিটারে বোল্ড হরফে যে তিন শ্রেণী বিদ্যমান তাদের মধ্যকার অন্তর্জালের এক অসাধারণ দ্রবণ নাগরিক জলপত্র ও জলমগ্নতার দহন।   

গল্পে আগাছা বলতে কিছু নেই। মুলগল্পের প্রত্যেকটা চরিত্রই প্রধান চরিত্র। প্রত্যেকে চরিত্রের রয়েছে নিজস্ব প্রয়োজনীয়তা। সময়জ্ঞান ও গল্পের স্বার্থে অতিরঞ্জন বা বাড়তি কোন সংযোজন নেই। আমার সবচে ভালো লেগেছে লেখক পুরো বই দুটি আলাদা আলাদা সময়ে এক ধ্যানে লিখেছেন। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রেখেছেন। এবং ক্ষুদ্রাতি এমন বিষয়কেও একে অপরের সাথে গুচ্ছবদ্ধ করেছেন যে প্রতিটা প্রেক্ষাপট, চরিত্রের অভিব্যক্তি ও কার্যক্রম দেখে এক আনমনেই আপনি লেখনির প্রশংসা করে বলবেন- সাধু সাধু। বরাবরি বলে এসেছি ম্যামের লেখা সামাজিক উপন্যাস গুলো এক ধরনের স্লো পয়জন। কিন্তু আজকে বলছি নাহ, এই বই দুটি হচ্ছে নিউরও টক্সিন। গল্প শেষে ঘায়েল আপনাকে হতে হবেই! 


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫