মাঝে মাঝে রোদ চকচকে আকাশের মতো ভালো লাগে

মাঝে মাঝে রোদ চকচকে আকাশের মতো ভালো লাগে। ভালো লাগে বেঁচে থাকার আনন্দে। খুব করে অনুভব করি জীবন খানিক হলেও সুন্দর। 
এই অনুভব অনুভূতি কেবল কিছু সময়েই খুব করে উপলব্দি হয়। কিন্তু সেই সময়টা কখন? 

নিজের উপর বিরক্ত আসেনি কখনো। শুধু আক্ষেপ এসেছে কেবল। এই যে এতো বিষণ্ণতায় ডুবে থাকা। এতো হাহাকার, এতো অপূর্ণতা তবুও কেন বেঁচে আছি জানতে চাইলে আমি কি বলবো? আমার পক্ষে এর সঠিক উত্তর দেয়া হয়তো সম্ভব নয়। কারণ এই প্রশ্ন এতোটাই জটিল যে আমি ভাববার মতো স্বজ্ঞান আমার থাকে না। 
আমি যখন লিখতে বসি। আমি কি লিখি? অন্তরকে নিঙরে লিখতে চাই সেসময়। বুকের বা দিকের থরথরে কেঁপে ওঠা আমি কখনোই অনুভব করিনি। বুকের একপেশে ব্যাথা কখনোই অনুভব হয়নি। শুনেছি কেবল। এখানেই নাকি জমে জীবনে বাঁচার তাগিদ। তবে বুকের মধ্য পাজরে আমার অনুভব হয় গ্লানি জমে উঠছে। কাই হয়ে জমে আছে কিছু একটা। যা খুব করে অবেগ তাড়িত করে আমায়। মানুষ তো। 
 
বয়সে তরুণ বলে, বুকের ব্যাথার কথা উঠলেই- সর্বসাকুল্যে আমাকে বিরোহী বা ব্যর্থ প্রেমিক হিসেবেই ধরে নেওয়া হবে। নেওয়াটাও স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য এই ধরে নেওয়ার শতভাগও মিথ্যে নয়। আমি অস্বীকারও করি না। কিন্তু এও তো সত্য এর সিকি ভাগে প্রেম থাকলেও বাকি অংশ জুড়ে আছে অন্যান্য জৈবনিক কোলহ। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে সে সব উগলে দিতে চায়। কিন্তু উগলাবে কোথায়? মানুষ যে বড্ড একা। উগলানোর পাত্রেও ফুটো থাকে। পরে যা বিষ হয়ে পুনরায় অন্ত্রে ফিরে।

মানিক বাবুর দর্শন বলে- 'ঈশ্বর মানুষকে আনন্দ উল্লাসের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, এর লঙ্ঘন করলে তিনি রাগ করেন।' তাই মানুষ কিছু কিছু সময় ভালো থাকে। কিন্তু সার্বক্ষণিক ভালো কখনোই সে থাকতে পারে না। আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে দুঃখ আসার কথা ছিলো। কিন্তু সেখানে মাঝে মাঝে আসে সুখ। আমরা ধরে রাখতে পারি কই? মোহমায়া এমনকি শুকরিয়া আদায় করে উঠার আগেই সুখ লুকায়, অতলে। ভীষণ অতলে। মূল কথায় আসি, তারুণ্য জীবনে দূর্ভোগ অর্থই ত্রিকাল জয়ী প্রেয়সী খুয়ে ফেলা। এ সিকি ভাগ সত্য হলেও শতভাগ নয়। তাহলে এখন প্রশ্ন বাকি দুর্ভোগ গুলো কি? 

ঝড় আসতে দেখলে, উত্তাল নদী তীরে দাঁড়িয়ে আমরা ঝড় উপভোগ করি না। তড়িৎ ঘরের কপাট আটকে ঘাপটি মেরে বসে থাকি। অনুভব করি ঝড় বয়ে যায়। কিছু একটা ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। হয়তো প্রাণটাও। অপেক্ষা করি ঝড় শেষ হওয়ার। কবু কি করি ঝড় কিভাবে হলো, কেন হলো কিংবা তার বিষদ আলোচনা।

মানুষ এতো এতো আকাঙ্খা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে আমাদের ঘিরে থাকা নিয়মগুলো ভাবে বোধহয় আমরা ট্র্যাক থেকে ছিটকে সরে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারে। আদৌ কি তাই? চঞ্চল ছুটে চলা পাখি গুলোকে বেঁধে দেওয়া হয় বহু নিয়মে গড়া ট্র্যাকে। এবার ছোটো…ডানা ছাড়াই। চোখ বাঁধা। শুধু শুনে শুনে এগোবে। প্রকৃতি নিয়ম লঙ্গন করে না। তাই উড়ে চলা পাখিকেও আকাশের সীমা দেখানো হয়। নিজ নিজ দায়িত্ব শেখানো হয়। পাখিটি বিশাল আকাশের মাঝে সীমা দেখে কুঁকড়ে পড়ে। তার কাছে এই খোলা মফশ্বলও ছোট হয়ে যায়। যেনো বন্দিশালা।

মানুষের ভালো না থাকার শিরভাগ কারণ হলো সীমাবদ্ধতা। অনেক কিছু চাওয়ার পর- যদি কিছু অংশও মেলে মানুষ সুখী হয়ে যায়। লোকে বলে মানুষ লোভী। এই লোকেরাও মানুষ। মানুষই মানুষকে লোভী বলে আখ্যা দিয়েছে। আমি বলি মানুষ লোভী না। সুখ খোজার নেশায় কুঁকড়ে যাওয়া মানুষগুলো আর সুস্থ নেই। অসুস্থ মানুষকে আর দোষ দেয়া যায় না। অন্ধকারে মানুষ অবশ্যই ডুবে যায়। ঘোর অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারেও মানুষ শুধু নিজেকেই দেখতে পায়। ভীষণ শূন্য নিজেকে দেখতে পারার মত ভয়ংকর দৃশ্য দ্বিতীয়টি নেই। এই শূন্য একাকী মানুষটি তখন আর কাউকে না পেয়ে যে বিকারগ্রস্ত সময় অনুভব করে তাকেই বলে বিষণ্ণতা। কোথাও একটা পড়েছিলাম- যদি কোন কারণ ছাড়াই কয়েক সপ্তাহ আপনি বিষণ্ণ থাকেন, তাহলে বুঝে নিতে হবে এটা আপনার রোগে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যে মানুষের কারণ শেষ হয় না কিংবা একই কারণ ঘষামাজা করে নতুন ভাবে বিষণ্ণ করে তোলে কাউকে? অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়? 

জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) এর বহুল জনপ্রিয় একটি লাইন আছে- 'মৃত্যুর স্বাদ সবাই পাবে, জীবনের স্বাদ পাবে খুব কম লোক।' এই লাইনটা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কি? তাহলে কি জীবন্ত মানুষদের একটা বিশাল অংশ জীবনের স্বাদ পায়নি/পাচ্ছে না? তাহলে এরা বেঁচে আছে কেনো? আত্মবলিদানে পরোলোকিক শাস্তির ভয়ে? যে ইহলোকে ভালো ছিলো না সে কেনো পরলোকের চিন্তা করবে? 

তারুণ্যের রক্ত এতোই গরম যে চুন থেকে পান খসলেও এরা বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে হেরফের করে না। এই হুলস্থুল কাণ্ডকারখানার ক্ষণভাগ যে তরুণ হিসেবে আমি করেনি তা অস্বীকার করলে জাত চলে যাবে। বরং জাত রক্ষায় স্বীকার করাই শ্রেয়। তবুও দিব্যি বেঁচে আছি, শ্বাস নিচ্ছি, আহারাদি সহ জৈবিক কৃতকর্ম সবই পূর্বের মতোই আছে। কিন্তু কিভাবে? কারণ চরম দুর্দশার দিনেও মাঝে মাঝে রোদ চকচকে আকাশের মতো ভালো লাগে। ভালো লাগে বেঁচে থাকার আনন্দে। খুব করে অনুভব করি জীবন খানিক হলেও সুন্দর। আমাকে জিইয়ে রাখে, কিছু কবিতা আর কিছু গান। 

এমনি দুর্দশার দিনে আমি যখন ঘোরগ্রস্থ হয়ে কবিতা পড়ি- স্বয়ং কবিতা আমাকে বলে আরো কিছুক্ষণ বেঁচে থাকো। দেখো আমি কি সুন্দর, ঠিক তোমার জীবনের মতোই। দেখো আরো কিছু স্বপ্ন দেখো। ফুল ফুটে, ঝরে যাওয়ার জন্য। তাই বলে গাছে কি আক্ষেপ করে? সে আবার ফুল ফোঁটায় আবার হাসে। আমি বেঁচে যাই। আমাকে বাঁচিয়ে রাখে কবিতা। তখন আমিও হয়ে উঠি ফুলচাষি। নতুন করে বুনি চারা। ফলাই নতুন কোন ফুল। যে সুবাস আমাকে যেনো আরো সারিয়ে তোলে।  

এমনি দুর্দশার দিনে প্লে-লিস্টের বাইরে অজস্র গান শুনি। চেনা গানের বাইরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজ্যান্স মাঝে মাঝে আমাকে আরো অনেক গান শোনায়। আমি শুনি। বিষণ্ণতার দেয়ালে সাধারণ, অতিসাধারণ কিংবা অখাদ্য বিরক্তি বাড়িয়ে তুলে। তিক্ত মনে সেসব গান বদলে দেই। কিন্তু এদেরই মাঝে ভীষণ প্রতাপে বিষণ্ণতার দেয়ালে আঘাত হেনে চুরমার করে দেয় কিছু গান। আমি প্রথমে অবাক হই। এরপর ভীষণ মনোযোগে দুকান পেতে রাখি। আমার হৃদয় গলে, শোকসভা পণ্ড হয়। তখন বলি- কি দারুণ। একবার, দুবার, পাঁচবার, দশবার বারবার শুনি এক গান। মস্তিষ্কের রক্তচাপ বাড়ে। আমি বেঁচে যাই। আমাকে বাঁচিয়ে রাখে গান। তখন আমিও হয়ে উঠি গানের সেবক। নিজেকে বাঁচিয়ে যেনো তখন স্রষ্টারই সেবা করি।  


 রাত ১২ঃ৩৪ / বুধবার 
৩০ মার্চ ২০২২ 
নারায়ণগঞ্জ। 

মন্তব্যসমূহ

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫