একটি সরল ও সুন্দর উপন্যাস - ক্রীতদাস

পৃথিবীতে যেসব জিনিস অত্যন্ত সুন্দর তাদের তেমন কোন জটিলতা থাকে না। অর্থাৎ সুন্দর জিনিসের গঠন সবসময়ই হয় অতি সাধারণ ও সরল। যদি একটা সুন্দর উপন্যাসের বর্ণনা দিতে বললে- আমি কয়েকটা জিনিসের উপস্থিতির কথা সর্ব আগে উল্লেখ করবো। যেমন বলা যেতে পারে- গল্পের মাধুর্য, ধারাবাহিকতা, চরিত্র বিন্যাস, কাহিনী সংলাপ ও সময়জ্ঞান, প্রয়োজনীয় উপমা, মূল প্রেক্ষাপটের পর্যাপ্ত প্রকাশ ও যৌক্তিক সমাপ্তি। এই প্রত্যেকটি ধারার সমবিন্যাসের ব্যবহার পেয়েছি এবারের বই মেলায় প্রকাশিত শারমিন আহমেদ এর ‘ক্রীতদাস’ বইটিতে। 

চিত্র ঃ বইয়ের মূল প্রচ্ছদ 

রাষ্ট্রযন্ত্রের যাতাকলে হারিয়ে যাওয়া একজন বাবা ও অতি আদরের মেয়ে নিশিকে নিয়েই সুন্দর একটা প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বইটিতে। মূলত লেখিকা বাবা ও মেয়ের সখ্যতা এবং আজন্ম বন্ধনের সুতোর উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এক সমাজ ও সভ্যতাকে। যেখানে সবাই কোন না কোন অদৃশ্য বেড়ি পরে আছে হাতে। যার থেকে মুক্তি নেই কারো। কিংবা কেউ কেউ ভুলে গেছেন মুক্তি কি জিনিস। 
রাষ্ট্র যখন কোন আসামীকে শাস্তি দেয় তখন সে দেখে কেবল আসামী ও তার অপরাধ। কিন্তু তারা দেখে না, তাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে। রাষ্ট্রযন্ত্রে ক্ষমতা ও পালাবদলের সুরে হারিয়ে যাওয়া মানুষরাও যে বেঁচে থাকে তাদের পরিবারের মানুষদের প্রতি অন্যায় অপমানে তার বলিষ্ঠ উদাহরন ফুটে উঠে বইটিতে। 
একজন বাচ্চা মেয়ের কাছে তার আদরের বাবা হঠাৎ হারিয়ে গেলে এবং সেই আদরের বাবাটিকে নিয়ে প্রতিনিয়ত সমাজের কালো চোখের নিচে পড়তে হলে মেয়েটির মানসিক অবস্থা ও কি পরিমাণ ট্রামার মধ্যে সে বেড়ে ওঠের তারই বহিঃপ্রকাশ ‘ক্রীতদাস’। 

ম্যামকে মেলার মাঠে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- বইয়ের নাম যেহেতু ক্রীতদাস তাহলে বইয়ের প্রচ্ছদ সাদা কেনো? গুতানুগতিক ভাবে ক্রীতদাস শব্দের সিম্বল বলা যায়- অন্ধকার, রক্তাক্ত ছোপ আর জলের দাগ। 
ম্যাম বলেছিলো- আমরা সবাই ক্রীতদাস। বইটা পড়লেই তুমি কারণটা জানতে পারবে। 

বইয়ের মূল গল্পে প্রবেশ করতেই আমি টের পেয়েছিলাম এর যৌক্তিক কারণ। আসলেই তো আমরা সবাই ক্রীতদাস। আমাদের পেটে-পিঠে নেই কোন রক্তছাপ, চোখের নালায় নেই কোন জলের দাগ। তবুও আমরা সবাই আছি কোননা কোন মায়াজালে, বেড়াজালে। আটকে আছি ধারাবাহিক সভ্যতায়। বইয়ে একটা লাইন আছে- 
‘এখানের সমাজ পুরোনো সুতো নতুন সুঁইয়ে ভরে মালা গাঁথে। এখানে নতুনত্ব পাবে কই?‘ 

বইটার একটা জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো- কাহিনী সংলাপে স্ট্রেইটফরওয়ার্ড কথা বলা হয়েছে। এতে তেমন বেশি উপমার ব্যবহার নেই। রুটিনমাফিক মশলার মতো সামাজিক জনরার বইয়ে প্রচুর পরিমাণে উপমা ব্যবহার করা হয়। সেগুলোর সব যে খারাপ লাগে তাও কিন্তু নয়। তবে অতিরিক্ত উপমা হয়তো বইটাকে এমন গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ করতে পারতো না তাই বোধহয় লেখিকা খুব সতর্কে খুব কমই এর ব্যবহার করেছেন।
বইটির আরেকোটা সুন্দর জিনিস হচ্ছে- গল্প বলায় লেখিকার তাড়াহুড়ো করারও কোন লক্ষণ ছিলো না। গল্পের প্রয়োজনেই সংলাপ ও সমাপ্তি এই নীতিতেই বোধহয় গল্পের প্লট তৈরি করেছিলেন লেখিকা। ক্রীতদাস খুব সরল ও স্বাভাবিক গল্পের একটি উপন্যাস। সুন্দর জিনিসের একটাই নাম হয়- সে সুন্দর।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫