জীবনের সুর-সংগ্রাম ও শব্দের ছন্দপতনের ঐকতান - শাপমোচন

বহুদিন পর অতি সুখাদ্য ও স্বাস্থ্যকর একটি বই পড়লাম। কি তার ভাষাশৈলী, কি তার আমেজ! বই শেষ হওয়ার পরও তার রেশ যেনো যেতেই চাইছে না। আজ খুব দুঃখের সহিত মনে হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের এমন এক সুপুষ্ট নক্ষত্র বড্ড দেরি করেই আমার দৃষ্টিগোচর হলো। 

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এর প্রবল আলোচিত ও বাংলা সাহিত্যের তরল সৌন্দর্য, প্রভাব ও রূপরসের এক সুঠাম ভিত্তি হচ্ছে 'শাপমোচন'। অসাধারণ এক গল্প প্লটে রচিত এর উপাখ্যান যেনো শিল্প সাহিত্যের কোমলতা ও সৌরভ খুব কাছ থেকে অনুভব করায়। ইতোপূর্বে আমার পঠিত সেরা বই গুলোর তালিকায় আজ থেকে এর স্থান থাকবে শীর্ষ থেকে শীর্ষস্থানীয়। এমন একটি বই লিখে- লেখক যেনো বাংলা সাহিত্যের মাধুর্য, রূপ গুণ ও কোমলতা খুব স্পষ্ট প্রকাশ করে দিলেন। বাংলা ভাষার এতো সুবিন্যস্ত মধুর প্রকাশ আমি এর পূর্বে কোথাও দেখিনি।  



ছবি : বইয়ের মূল প্রচ্ছদ

মূল গল্পঃ

একসময়কার প্রতাপ হারানো এক সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারের ছেলে মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায় পরিবারের চরম দুর্দশায় গেয়ো গ্রাম ছেড়ে চাকরির খোঁজে রওয়ানা করে কলকাতার পথে। গন্তব্য পিতৃবন্ধু উমেশ ভট্টাচার্যের বাড়ি। অন্ধ দাদা দেবেন্দ্র নাথ, বৌদি অপর্ণা ও তার শিশু দেবতাতূল্য ভাইপো খোকনের কথা চিন্তা করেই তার এই গৃহত্যাগ। 
অচেনা শহর কলকাতায় বিজয়া দশমীর দিন একরূপ ভিখারি সেজে প্রবেশ করা মহেন্দ্রের, বেশ আপ্যায়নের সাথেই ঠাই হয় উমেশ বাবুর বাড়িতে। প্রথম দর্শনে ভিখারি সাদৃশ্য যুবককে বাড়ির কর্তা ও ছোট কন্যা ব্যতিত কেউই তেমন গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে সে হয়ে ওঠে তাদেরই একজন। অবশ্য বলা যায় এর সব কর্তৃত্ব কেবল মাধুরীর। মাধুরীলতা ভট্টাচার্য। উমেশ বাবু, কর্তা গিন্নি ও তিন ভাই ও বৌদিদের পরিবারে অতি আদরের এক বোন হিসেবে অতি চঞ্চল, বাকপটু ও তুখোর বুদ্ধিমতী অষ্টাদশী তরুণীই হলো এই গল্পের প্রধান চরিত্র।    

এমন বনেদী ঘরে ঠাই পেয়েও মহেন্দ্র যেনো নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলো না। অনেকটা ধূলোর সাথে চিনে মাটির মেলামেশা। কিন্তু মহেন্দ্রের অন্ধের ষষ্ঠী হিসাবে দেখা যায় মাধুরীকে। সারাদিন মহেন্দ্রকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সহ নানাবিধ চিন্তা ও শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ঘটতে থাকে তাদের মধ্যে। উমেশ বাবুর পক্ষ থেকে মহীনের দাদা দেবেন্দ্রকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা করে পাঠালেও মহীন চাকরি পাওয়া মাত্রই উমেশবাবুর গৃহত্যাগ করে মেসে গিয়ে উঠে। গল্পে আর্থিক অবস্থার দিক থেকে দীন হলেও মহেন্দ্র ও তার দাদার মন মানসিকতা দেখা যায় বেশ ব্যাক্তিত্বপূর্ণ। তাই অন্যের সাহায্যের চাইতে নিজের রোজগারকেই প্রাধান্য দেওয়ার বিস্তর প্রকাশ দেখা যায়।

মেসে গিয়ে উঠলেও প্রায়ই মহেন্দ্রের মেসে গিয়ে তার দেখভাল ও তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আসে মাধুরী। মহেন্দ্রের উচ্চ মন মানসিকতা, কণ্ঠস্বর ও সেতার বাজানোর অপরূপ মুগ্ধতা ধীরে ধীরে আকৃষ্ট করে মাধুরীকে। এভাবেই মহীনও কখন মাধুরীর প্রণয়ে ডুবে যায় তা সে নিজেও ধরতে পারে না। 
তার ঘোর ভেঙে যায় মাধুরীর বড় বৌদির কথায়। মাধুরীর সুখের কথা ভেবে যারা কি-না ভাবছে মহীনের সাথের মাধুরীর সুতো গাঁথবার। 

মাধুরীর মতো রাজবংশীয় মেয়ে মহীনের জীর্ণকুঠিরে গিয়ে থাকতে পারবে না। এই অপারাগতার কথা চিন্তা করেই একরূপ কলকাতার একমাত্র আশ্রয়দাতাদের কাউকেই না জানিয়ে অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে যায় মহীন। মহীনের এই অঘোষিত প্রস্থান মাধুরী মেনে নিতে না পারলেও মনে মনে কারণ খুঁজতে থাকে কেন মহীন তাকে ছেড়ে চলে গেল? 

মাধুরীকে ছেড়ে এসে মহীন নিজেও মনঃকষ্টে পুড়তে থাকে। মাধুরীর দেওয়া সেতারায় প্রতি রাতে কোমল বিরহের সুর তুলে অন্তরের অগ্নিশিখা নিবারণের চেষ্টা করে সে।
অন্যত্র চাকুরি করতে গেলেও বেশিদিন সেখানে থাকতে পারেনা। কলকাতায় থাকতেই এক দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে ঘিরে ধরে। যা সম্পর্কে সকলেই ছিলো অজ্ঞ। একদিন মহীন ফিরে আসে তার নিজের গেয়ো গ্রামে- দাদা বৌদির কাছে। যে খোকনের মুখে দুধ তুলে দিতে এক দশমীর দিন গৃহত্যাগ করেছিলো মহীন, সেই খোকনকে আজ ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ায় কোলে পর্যন্ত তুলতে পারলো না সে।   

এমনি এক দশমীর দিন মহীনের প্রাণ বায়ু বেড়িয়ে গেলো চন্ডীপুরের জীর্ণ কুঠিরে। এদিকে মহীনের কোন ঠিকানা না জানায় এই দশমীর দিন চন্ডীপুরের ঠিকানায় চিঠি পাঠায় মাধুরী। চিঠিতে তার নাম উল্লেখ করলেও কোন ঠিকানা দেয় না। তার ধারণা মহীন যেখানেই থাকুক দশমীর দিন খোকনের টানে সে বাড়ি ফিরবেই আর তার চিঠি সে দেখবে। মহীনের মৃত্যুর পরও প্রতি দশমীতে চিঠি আসতে থাকে।
খোকন বড় হতে থাকে। একসময় সেই এই চিঠি প্রেরণকারীর খোঁজে বের হয় কলকাতার পথে। একসময় চিরকুমারী মাধুরীকে পেয়েও যায়। কিন্তু মাধুরীর মুখে মহীন সম্পর্কে জানার অপার আগ্রহ ও তার অন্তরে ও বিশ্বাসে স্ত্রী সন্তান নিয়ে খুব সুখে থাকা মহীনের ধারণা ভেঙে তার মৃত্যুর খবর দেওয়ার শক্তি খোকনের হয়ে ওঠে না।  

পাঠ পর্যালোচনা ঃ

একটা বই কতটা সতেজ ও সজীব হতে পারে তা 'শাপমোচন' না পড়লে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই। পৃথিবীর দ্বিতীয় শ্রুতিমধুর ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষার অকুল শ্রুতিমধুরতা, ভাষার সাবলিল প্রকাশ ও শব্দশৈলীর এতো সুন্দর সুবিন্যস্ত প্রকাশ খুব কম বইয়েই পাওয়া যায়। বইটিতে তে যেনো শব্দের খেলা করা হয়েছে। এতো বিন্যস্ত শব্দের ছন্দপতন বইটিকে অমৃত করে তুলেছে। 

বাংলার মানুষের মন ও মননের বিকাশে গ্রামীণ শিল্প সংস্কৃতির বিস্তর আলোচনার পাশাপাশি বংশীয় ধ্যান জ্ঞান ও গৌরব পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। দেবেন্দ্র ও উমেশ বাবুর বংশীয় আর্থিক অবস্থার বিস্তর ফারাক থাকলেও শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ও ধারাবাহিকতার প্রভাব যেনো বাংলার মানুষের নিঃসৃত প্রধান উপঢৌকন রূপে ধরা দিয়েছে। সাহিত্য ও সঙ্গীতের কোমলতা, সুর, লয়ের এমন ঐকতান রয়েছে বইটিতে যা একজন পাঠককে সত্যিকার বাঙালি করে তুলবে।
একজন পাঠক হিসেবে বইটি নিয়ে আলোচনা করার বহু বিষয় আছে কিন্তু আমার মতে অন্তত এই বইটিতে সমালোচনা করার কিছুই নেই। ঘোরোয়া গল্পের প্রেক্ষাপটে এমন বিস্তর শব্দবিন্যাস আমি আর কোথাও দেখি নি। 


ছবি ঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 


লেখক সম্পর্কেঃ 

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার খয়রাশোলের নাকড়াকোন্দা গ্রামে ৭ই মার্চ ১৯০৪ সালে । ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় মূলত তার ছদ্ম নাম। তার আসল নাম তারাপদ। বাংলা সাহিত্যের সাবলীল রচনা সৃষ্টিতে তিনি প্রবাদ পুরুষ। ঔপন্যাসিক হিসেবেই তার খ্যাতি প্রচুর। কাজ করেছেন বঙ্গলক্ষ্মী মাসিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে।
তার বহুল আলোচিত উপন্যাস- চিতা বহ্নিমান, আকাশ বনানী জাগে (১৯৪৩), আশার ছলনে ভুলি (১৯৫০), বহ্নিকন্যা (১৯৫১), ভাগীরথি বহে ধীরে (১৯৫১)। এছাড়াও হিঙ্গুল নদীর কূলে (১৯৩৫), কাশবনের কন্যা (১৯৩৮) তার জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। 

বাংলা সাহিত্যে পাঠক সৃষ্টিতে তার রচনা বেশ অবদান রেখেছে। আধুনিক শিল্পসম্মত উপন্যাস রচনায় তার অবদান অনস্বীকার্য। ২৫ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে ৭১ বছর বয়সে এই মহান স্রষ্টার জীবনাবসন হয়।  

বই সম্পর্কে ঃ
  • বই ঃ শাপমোচন (বাংলাদেশী প্রিন্ট) 
  • লেখক ঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
  • প্রকাশনী ঃ সূর্যোদয় প্রকাশন
  • প্রচ্ছদ ঃ এম এ আরিফ 
  • মূল্য ঃ ২০০ টাকা মাত্র। 

মন্তব্যসমূহ

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫