কারা জীবনে এক ছটা উচ্ছ্বাসের নাম- আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
কবিতার আংশিক টাইপোগ্রাফি |
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জন্য এক বুক গর্বের একটি নক্ষত্র। তাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাই আজকে একটি নির্দিষ্ট কবিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করবো। বহুল পঠিত কবিতাটি হলো - আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
নজরুলকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে চিনে না এমন মানুষ বোধহয় বাঙালিদের মধ্যে কেউ নেই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুর্দর্ষ সব কবিতা লিখে বেশ কয়েকবার জেল খাটতে হয়েছে কবিকে। এই বিষয়ও কারো অজানা নয়। তবে এই জেল জীবনে বসেও কবির লেখার হাত থেমে থাকে নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কবি কঠোর হস্তে লিখে গেছেন আগুন ঝরা সব কবিতা।
১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে কবির প্রকাশিত 'অগ্নিবীণা' কাব্য গ্রন্থ প্রকাশের এক মাসের মাথায় ২৩ নভেম্বর তা বিট্রিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এটি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিলো। এদিকে ২২ সেপ্টেম্বর কবির সম্পাদিত পত্রিকা ধুমকেতু তে প্রকাশিত কবিতা 'আনন্দময়ীর আগমনে' প্রকাশের কারণে ৮ নভেম্বর কবির বিরুদ্ধে ফৌজদারী দন্ডবিধি আইনের ১২৪-ক ধারা অনুসারে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে পুলিশ। পরে ২৩ নভেম্বর কুমিল্লার ঝাউতলা মোড় থেকে কবিকে আটক করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর কবির বিরুদ্ধে বিচার কার্য শুরু হলে কবির পক্ষ সমর্থনে মলিন মুখপাধ্যায় সহ বেশ ক'জন আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে আইনি লড়াই করেন। তবে কবির বন্ধু এবং ধূমকেতুর প্রকাশক আফজালুল হক কবির বিরুদ্ধে সরকারের হয়ে সাক্ষি দেন। অবশেষে বিচারক সুইনহো মামলার রায় দেন। এসময় কবিকে রাজদ্রোহের মামলায় এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৭ জানুয়ারি ১৯২৩ সালে কবিকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকা অবস্থায় এক দারূন ঘটনা ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সদ্য প্রকাশিত নাটক 'বসন্ত' কবিকে উত্সর্গ করেন। বসন্তের একটি কপিতে রবীন্দ্রনাথ নিজের সাক্ষর দিয়ে কপিটি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে বলেন- 'আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।'
এই জেল হাজতে বসে এই খবর শুনে কবি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। আর তখনই রচনা করেন 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে' শীর্ষক কবিতাটি। এই কবিতাটিতে কবির কারাজীবনে রবী ঠাকুরে মতো মানুষকে পাশে পাওয়ার আনন্দ বিস্তর ভাবে ফুটে উঠে।
কাজী নজরুল ইসলাম
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে -
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;
আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে.
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!
বাহ কবিতার শানে নুযুল যেনে বেশ ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন