লাইব্রেরি অব কংগ্রেস - এক রাজকীয় লাইব্রেরির জন্ম বৃত্তান্ত।
| ছবি : লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ( একাংশ ) |
লাইব্রেরি এমন একটা শব্দ যে শব্দটার উৎপত্তি হওয়ার আগেই মানুষ প্রয়োজনীয় পুস্তক, পুঁথি, কিতাব সংগ্রহ ও অন্যের প্রয়োজনে তা ব্যবহারের নিয়মনীতি শিখে গিয়েছিলো। জীবনের তাগিদেই মানুষ নতুন যা কিছু উৎঘটন করতো বা জানতে পারতো তাই সংগ্রহ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ঠিক এরই পরিক্রমায় তথ্য লিপিবদ্ধকরণ ও সংগ্রহ করার তাগিদে শুরু হয় সংগ্রহশালা তথা লাইব্রেরির পথচলা।
| ছবিঃ আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ( Ancient World Magazine ) |
ইতিহাস
লাইব্রেরি অব কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ২৪ এপ্রিল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। মূলত প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস কংগ্রেসের একটি নতুন আইন পাস করার মাধ্যমে Philadelphia কে বাদ দিয়ে Washington, D.C কে রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেয়।
রাজধানী পরিবর্তন আইনের আনুষাঙ্গিক খরচের মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসের ব্যবহার্য বইয়ের জন্য $৫,০০০ বরাদ্দ করা হয়। এরপর টমাস জেফারসনের অধীনে কংগ্রেস আরেকটি বিল পাস করে। যার মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের অধীনে রেখে কিছু মানুষকে গ্রন্থগারের অফিসিয়াল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
| ছবিঃ প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস ( Whitehouse.gov ) |
লাইব্রেরি অব কংগ্রেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম ফেডারাল সংস্কৃতির অংশ। বিশেষ করে কংগ্রেসের গ্রন্থাগারিক দ্বারা শুরু থেকে এটি পরিচালিত হতে থাকে।
নানামূখী ভাঙন ও পুনর্গঠন
লাইব্রেরি অব কংগ্রেস মূলত মার্কিন কংগ্রেসের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকাশ পায় এবং পরবর্তীতে এটি আমেরিকার জাতীয় গ্রন্থাগারে রূপ নেয়। প্রতিষ্ঠার পরপরই লাইব্রেরিটি তাদের সংগ্রহশালার বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শুরু করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
| ছবিঃ নির্মাণাধীন লাইব্রেরি অব কংগ্রেস মূল ভবন ( C-SPAN/Youtube ) |
১৮১২ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৮১৪ তে এসে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের মূল স্থাপনা ও এর বেশির ভাগ অরিজিনাল ডকুমেন্ট, বই, তথ্যাদি ধ্বংস হয়। তবে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ ১৮১৫ তে এসে আবার লাইব্রেরিটি পুর্ণগঠন ও সংস্কার করে। এই সংস্কারের সময় তারা প্রায় $২৩,৯৫০ ডলারে টমাস জেফারসনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা প্রায় ৬ হাজার ৪৮৭ টি বই কিনে নেয়। যার মাধ্যমে পুনরায় লাইব্রেরিটি বর্ধিত হতে শুরু করে।
| ছবিঃ টমাস জেফারসন ( timeforkids.com ) |
কিন্তু ১৮৫১ সালে ক্যাপিটল চেম্বারে অগ্নিকান্ডের ফলে লাইব্রেরিটি চুড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ওই অগ্নিকান্ডের ফলে প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের অধিকাংশ বই এবং প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহদি সহ প্রায় ৩৫ হাজার ভলিউম পুড়ে যায়। যা লাইব্রেরিটির জন্য ছিলো অপূরণীয় ক্ষতি।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর থেকেই এই লাইব্রেরিটির কদর বাড়তে শুরু করে। তখন লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ পুড়ে যাওয়া তথ্যাদি, বই, ডকুমেন্টের অনুলিপি কেনার প্রচারণা চালায়। এরপরই গ্রন্থাগারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত ২টো বই, মানচিত্র এবং ডায়াগ্রামের কপিরাইট পায়। এটিই তাদের অন্য সংগ্রহ গুলো সংরক্ষণে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহয়তা করে।
| ছবিঃ লাইব্রেরিতে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিকী ছবি। ( amazon.com ) |
গৃহযুদ্ধের আগে এটি শুধু মাত্র কংগ্রেসের সদস্যদের ব্যবহারের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেই ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন আনেন আইনওয়ার্থ র্যান্ড স্পফফোর্ড । বলা যায় তার হাত ধরেই লাইব্রেরি অব কংগ্রেস এক নতুন রূপে প্রকাশিত হতে শুরু করে। তিনি কংগ্রেস সদস্যদের এটা বোঝানো শুরু করেন যে এটি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হতে পারে। যা জনগণ ও কংগ্রেসের সদস্যরা নির্বিঘ্নে ব্যবহার করতে পারবে। পরবর্তীতে তিনিই ১৮৭০ এর কপিরাইট আইনের প্রচার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কপিরাইট অফিসকে এই লাইব্রেরির আওতাধীন করেন। এবং তার হাত ধরেই লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠার প্রায় এক শতাব্দী পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় রেনেসাঁ ধরণে একটি নতুন বিল্ডিং নির্মাণের অনুমোদন পায়।
রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও সংগ্রহশালার প্রসার
বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে এসে লাইব্রেরির তুমুল পরিবর্তন হতে শুরু করে। মূলত এই সময়টাতেই এসে লাইব্রেরির সবচেয়ে মূল্যবান নিদর্শনগুলো সংগ্রহশালায় জমা হতে শুরু করে।
১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট একটি নির্দেশ জারি করেন। তাতে কংগ্রেসের কন্টিনেন্টাল রেকর্ড ও ওয়াশিংটনের ছয় প্রতিষ্ঠাতা- জর্জ ওয়াশিংটন, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জেমস ম্যাডিসন ও জেমস মনরো এর ব্যক্তিগত সংগ্রহ, বই, ডায়েরি লাইব্রেরিতে স্থানান্তর করা হয়।
এরপর প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন জি হার্ডিং আরেকটি নির্দেশ জারি করেন। যে নির্দেশের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মূল অনুলিপি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে সংগ্রহ ও জনগণের সামনে প্রদর্শন করা শুরু হয়।
| ছবিঃ পাখির চোখে লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ( Britannica.com ) |
সর্বশেষ ১৯৮০ সালে জেমস ম্যাডিসনের নামে তৃতীয় মূল বিল্ডিং নির্মাণ করা হয় যা লাইব্রেরিটির আকার দ্বিগুন করে। এবং আধুনিকরণের মাধ্যমে পুরোনো দুটি ভবনকে ১৮৯৭ এর টমাস জেফারসন ও ১৯৩৯ এর জন অ্যাডামস মূল ভবনের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। আজকের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস জেফারসন বিল্ডিং ও ২১ টি রিডিংরুম নিয়ে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।
বর্তমান লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ও মূল্যবান নিদর্শন
মূলত প্রযুক্তির ছোঁয়া বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে আমাদের দ্রুতই পরিবর্তন করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় ইন্টারনেট ও অনলাইন ভিত্তিক ব্যবস্থার প্রচার ও প্রসার বেড়েছে হাজার গুন। কংগ্রেস তাদের ওয়েবসাইট এবং ডিজিটাল লাইব্রেরি ব্যবস্থা শুরু করে ১৯৯৪ সালে।
| ছবিঃ ড. কার্লা হেডেন বর্তমান গ্রন্থাগারিক ( Thedailyrecord.com ) |
২০১৬ সালে কার্লা হেডেন (বর্তমান) প্রথম মহিলা গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিয়োগ পান। তার অধীনে সাধারণ কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার এবং বইয়ের সংখ্যা ৩৮ মিলিয়ন এবং পান্ডুলিপির সংখ্যা প্রায় ৭০ মিলিয়ন!
| ছবিঃ মূল রিডিং রুম, জেফারসন বিল্ডিং ( Fourth Estate/Leigh Norman ) |
বর্তমানে লাইব্রেরিতে বেশ কিছু বিরল বইসহ ৬১ মিলিয়ন পান্ডুলিপি, আমেরিকার ১ মিলিয়ন পত্রিকা, ৫ লাখ মাইক্রোফিল্ম রিল, ১ লাখ ২০ হাজার কমিক বই, ৫৩ লাখ ম্যাপ, ৬০ লাখ মিউজিক, ৩০ লাখ সাউন্ড রেকর্ডিং রয়েছে। প্রায় ২২০ বছর পুরোনো লাইব্রেরিটি সংগ্রহ সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর ১ম এবং আয়তনের দিক থেকে ২য় স্থানে অধিকার করে আছে।
লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি এর আর্ট ও প্রদর্শিত চিত্রকর্ম বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার গাঠনিক মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।