নির্যাতিত এক জাতির জেগে ওঠার গল্প- ফ্রন্টলাইন

প্রতিকী ছবি 

লতিফুল ইসলাম শিবলী এর এবছরের অমর একুশে বই মেলায় প্রকাশিত নতুন বই ‘ফ্রন্টলাইন’। তার লেখায় মূলত জাতি, দেশ এবং মানুষের উপর জুলুম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা ফুটে ওঠে। ফ্রন্টলাইন, তেমনি কয়েক যুগ ধরে নিপীড়িত একটি জাতির মুক্তির গল্প নিয়ে তৈরি। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের চলমান মূল একটি সমস্যা রোহিঙ্গা ইস্যু। বইটিতে লেখক কাল্পনিক ভাবেই খুব সুন্দর করে শরনার্থী রোহিঙ্গা জাতির মুক্তি পথ দেখিয়েছেন। মূল গল্প গল্পের শুরুতে দেখা যায়, উখিয়ার আদম ব্যবসায়ী মোক্তার মাঝির অনুসরনে প্রায় তিনশ যাত্রী নিয়ে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় ছোট একটি মাছ ধরার ট্রলার। তারা বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম করলেও মুনাউ দ্বীপের কাছাকাছি এসে মায়ানমারের নেভির কাছে ধরা পরে। শেষে এক মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নেভি অফিসারের হাত থেকে বেঁচে যায় তারা। মায়ানমার নেভির হাত থেকে রক্ষা পেলেও তারা বর্হিবিশ্বে একটি বার্তা ছড়িয়ে দেয় “বাংলাদেশ করোনা আক্রান্ত রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার জোড় করে ঠেলে দিয়েছে বার্মার জলসীমায়”। ঠিক এই খবরের পেয়েই সমুদ্র তীরবর্তী কোন দেশ তাদের ভিড়তে দেয় না।

ছবিঃ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, চিত্রসূত্র: একুশে টিভি

গল্পের প্রধান চরিত্র নাসিরউদ্দিন ও তার মা ছিলেন নৌকার যাত্রী হিসেবে। কিন্তু অসুস্থার কারণে নৌকায় তার মায়ের মৃত্যু ঘটে।নৌকায় মায়ের জানাজা শেষ করেই নিজ হাতে মায়ের লাশ ছুড়ে ফেলতে হয় আন্দামানের নীল পানিতে। ঠিক সেদিন যেনো মায়ের সাথে সাথে নাসিরউদ্দিন নিজের ভয় ও জাগতিক দূর্বলতা ছুঁড়ে ফেলে। নাসিরউদ্দিনের পরবর্তী আশ্রয় হয় কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখান থেকেই মূলত গল্পের শুরু।নিজ ভূখণ্ড থেকে নির্বাসিত হয়ে এই শরণার্থী ক্যাম্পে এসেও শান্তি নেই কারো। তাদেরই জাত ভাই নশু গ্যাং এর ইয়াবা ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জুলুম, মানব পাচার সহ্য করে যেতে হয় নিত্যদিন।

এদিকে দশ নম্বর ক্যাম্পের ছাপড়া মসজিদের ইমাম সামিউলের সাথে বসে রোহিঙ্গাদের মুক্তির এক সদূর প্রসারি পরিকল্পনা আঁটছেন মেজর শাফায়েত। তার প্রথম কথাই ছিলো- উই নিড এ হিরো! ইমাম নিজের জাতির অপারগতা জানলেও মেজর শাফায়াতের সাথে একাত্মা প্রকাশ করে নাসিরউদ্দিনকে রোহিঙ্গাদের নেতা বানানোর কাজ শুরু করেন।

প্রথম প্রতিরোধ হয় নশু বাহিনীর বিরুদ্ধে। ইমাম ও মেজরের কথা মতো নশু বাহিনীর দুই সদস্যকে সকলের সামনে কুপোকাত করা মাধ্যমে সকলের মনে নশু ভীতি কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে নাসিরউদ্দিন। এরপরই সকলকে নিয়ে গোটা নশু বাহিনীকে নির্মূল করার প্রয়াস শুরু করতে থাকে সে।আড়াল থেকে নাসিরউদ্দিনকে সাপোর্ট দিয়ে যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর শাফায়াত।

ধীরে ধীরে নাসিরউদ্দিরকে সমীহা করতে শুরু করে সকলে। সকলে যেন নাসিরউদ্দিনের মাঝেই নিজেদের মুক্তির স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। মেজর ও ইমামের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় নাসিরউদ্দিন নশু বাহিনীকে নিরর্মূল করতে ‘লাঠি বাশি সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে। নাসিরের এই অভিনব পন্থায় গোটা দল সহ কুপোকাত হয় নশু বাহিনী। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক ভাবে নশু পালিয়ে যায়।

ছবিঃ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প, চিত্রসূত্র: সমকাল

নশু বাহিনী পরাস্থ হওয়ার পর খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে লাঠি বাঁশি সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম। এবং ঠিক এটাই চেয়েছিলো মেজর। এরপর শুরু হয় তাদের মূল লক্ষ্যের দিকে হাটা শুরু করে। একটা এনজিও এই কমিটির সকলের জন্য টি-শার্টের ব্যবস্থা করে যার পিছনে লেখা থাকে-

‘সাহসীদের জন্য
এই পৃথিবী ধন্য’
মূলত মেজর শাফায়াত রোহিঙ্গাদের জন্য এতো কিছু করছেন এক মহান দায়িত্ববোধ থেকে। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম চান মুক্ত আরাকানের মাটিতে রোহিঙ্গারা ফিরে যাক এবং সেই মুক্ত ভূমিতে গিয়ে তিনি দু রাকাত শোকরানা সালাত আদায় করবেন।

লাঠি বাঁশি সংগ্রাম কমিটি থেকে বেছে বেছে সুস্থ দেড়শ যুবক নিয়ে নিঝুমদ্বীপের একটি চরে নিয়ে যাওয়া হয়। সকলকে বলা হয় দ্বীপে সরকারি বনায়ন কর্মসূচির জন্য তাদের কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু ডি-৩ নামক এই দ্বীপে পৌঁছেই তারা নিজেদের এক নতুন জীবন পায়। মূলত এখানেই প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হবে রোহিঙ্গাদের মুক্তির যোদ্ধাদের।

এখানেই তৈরি হতে থাকে ‘মুজাহেদ্বীন অব আরকান’ নামে রোহিঙ্গাদের মুক্তিকামী বাহিনী। তাদের মূলত নিজের দেশে ফিরে তাতমাডাও এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আরকানের মাটিকে মুক্ত করতেই এই প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। যুদ্ধের সকল নিয়মনীতি, অস্ত্রচালনা, গেরিলা আক্রমন, বাংকার তৈরি, ওয়াচ টাওয়ার বানানো ইত্যাদি কাজ শিখাতে থাকে মেজর শাফায়াত ও তার কিছু অধীনস্ত সৈন্যরা। একে একে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ট্রলারে করে আরো যুবকদের নিয়ে আসা হয়। তবে পরিবারদের জানানো হয় তারা বনায়ন কর্মসূচিতে কাজ করছে।

এভাবেই নিজেদের যোদ্ধারা তৈরি হয়ে গেলে নাসিরউদ্দিনের নেতৃত্বে তারা রওয়ানা দেয় নিজ ভূখন্ড আরকানের উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশের বর্ডার ক্রস করে তারা মংডু জেলার সীমান্ত ঘেষা অঞ্চলে ক্যাম্প করে। এবং তারা প্রথম সফল আক্রমণ চালায় প্বার্শবর্তী তাতমাডাও ক্যাম্পে। এভাবেই শুরু হয় তাদের মুক্তির পথচলা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশি দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক স্বার্থের কবলে পড়তে হয় তাদের। যারা তাদের দেশ থেকে শিকড় সমেত উৎখাত করেছিলো তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে খুব বাজে ভাবে মুজাহেদ্বীন অব আরকান কে উত্থাপন করা হয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত একটা জাতির মুক্তি কামী ছেলেদের সন্ত্রাসী সংগঠন নামে আখ্যা দেওয়া হয়।

গল্পের শেষে দেখা যায়, বাংলাদেশকেও চাপ দেওয়া হলে ক্যাম্প থেকে ইমাম সামিউলকে গ্রেফতার করা হয় এবং নাসিরউদ্দিনকে ধরতে নিরুপায় হয়ে সীমান্তে সৈন্য সমেত অবস্থান নেয় মেজর শাফায়াত। তবে নাসিরউদ্দিন ও তার যোদ্ধারা নিশ্চিত পরাজয় জেনেও শেষ লড়াইটা তাতমাডাও এর বিরুদ্ধে চালাতে জাপিয়ে পরে… 


পাঠ পর্যালোচনা

এর আগে আমি শিবলী ভাই এর বই আসমান পড়েছি। তার লেখায় একটা মেসেজ থাকে। যা সামগ্রিকভাবেই পরিবর্তনের মেসেজ। সত্য ও সুন্দরের পথে পরিচালনার মেসেজ। ফ্রন্টলাইন তেমনি একটি জাতির মুক্তির জন্য নিজেদের পরিবর্তনের বার্তায় রচিত। এক কথায় বইটা আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহীঙ্গারা গত কয়েক যুগ ধরে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে একতা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগরণের কোন লক্ষন দেখা যায় নি। মূলত তারা কখনোই সংঘবদ্ধ হতে পারেনি। লেখক খুব সুন্দর ভাবেই একতাবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। রোহিঙ্গাদের মুক্তির জন্য এই একতা কি পরিমাণ প্রয়োজন তাও ফুটিয়ে তুলেছেন।

ছবি : বইয়ের মূল প্রচ্ছদ 

কাল্পনিক ভাবে লেখক রোহিঙ্গাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার যে দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন তা সত্যি অসাধারণ। ঠিক বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সংঘবদ্ধ রোহিঙ্গাদের লড়াই ব্যাতিত মুক্তির কোন পথ নেই। তবে তাদের এই জাগরণে অবশ্যই প্রয়োজন একটি নীতিবান রাষ্ট্রের সার্বিক সাহায্য। যে দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। গল্পের প্রেক্ষাপট, স্থান-কাল ও চরিত্র এতো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে বইটি পড়ার সময় মনে হয়েছে যেনো দৃশ্যপট গুলো আমার সামনে ঘটছে। 

তবে বইটিতে কিছু জায়গায় খটকা লেগেছে। যেমন গল্পের শুরুতে, নাসিরউদ্দিন সহ যেই যাত্রীরা মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলো তারা কিভাবে ফিরে আসলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে? কেননা লেখক উল্লেখ করেছেন সমুদ্র তীরবর্তী সকল দেশ তাদের নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে কারণ এই ট্রলার করোনা আক্রান্ত রোহিঙ্গা বোজাই। কোন দেশই তাদের ভূমিতে এই ট্রলার ভিড়তে দিতে চায় না। তাহলে তারা আবার কিভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসলো এ ব্যাপারে তেমন কিছুই উল্লেখ করেননি তিনি।
দ্বিতীয় আরেকটা খটকা লেগেছে, লাঠি বাঁশি সংগ্রাম কমিটির আক্রমনে যখন নশু বাহিনীর ২০ জন কুপোকাত হয় তখন তাদের মধ্যে ১৯ জন মারা গেলেও নশু পালিয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে দেখলে নশু ছিলো দলের প্রধান এবং সাধারণ জনগণের তার প্রতিই ক্ষোভ ছিলো বেশি। তো এতো মানুষের গণপিটুনির রোষানল থেকে কিভাবে পালিয়ে গেলো সে।

এই দুটো ব্যাপার বাদ দিলে পুরো বইটা ছিলো সয়ঃসম্পূর্ন ঘটনা নির্ভর। চরিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ইমাম সামিউল হাসানকে এবং তার সংঘবদ্ধ করার শক্তিকে। এবং সর্বশেষ বলতেই হয় লতিফুল ইসলাম শিবলীর অন্যান্য বইয়ের মতো ফ্রন্টলাইন একটা মাস্টারপিস।

ছবি : লতিফুল ইসলাম শিবলী 


লেখক পরিচিতি

লতিফুল ইসলাম শিবলীর জন্ম ১৪ এপ্রিল নাটোরে। লেখকের প্রথম পরিচয় গীতিকবি হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিকের স্বর্ণযুগ ৯০ দশক জুড়ে লিখেছেন প্রায় তিনশোর অধিক গান। লিখেছেন ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘পলাশীর প্রান্তর’, ‘প্রিয় আকাশি’, ‘হাজার বর্ষারাত’, ‘জেল থেকে বলছি’ এর মতো তুমুল জনপ্রিয় কালজয়ী গান। নিজের কন্ঠ, সুর ও কম্পোজিশনে করেছেন একক অ্যালবাম - ‘নিয়ম ভাঙার নিয়ম’ (১৯৯৮)। 

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ইচ্ছে হলে ছুঁতে পারি তোমার অভিমান’ (১৯৯৫)। বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে বাংলা ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে তার গবেষণাধর্মী বই ‘বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত আন্দোলন’(১৯৯৭) । তার রচিত প্রথম নাটক ‘তোমার চোখে দেখি’ ও ‘রাজকুমারী’। তার কাহিনী সংলাপে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘পদ্ম পাতার জল’ (২০১৫)। লিখেছেন একাধিক বেস্ট সেলার উপন্যাস দারবিশ (২০১৭), দখল (২০১৮), আসমান (২০১৯), রাখাল (২০২০)।

বই সম্পর্কে: 

•         বইয়ের নাম: ফ্রন্টলাইন 
•         প্রকাশক: নালন্দা প্রকাশনী
•         প্রচ্ছদ: ওয়াহিদ তুষার
•         মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
•         প্রথম প্রকাশ: মার্চ ২০২১
•         ISBN: 978-984-95475-3-2

মন্তব্যসমূহ

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫