‘এই শহরে’ এক ভাঙ্গাচোরা শহুরে জীবনের গল্প


‘এই শহরে’ নূর হোসাঈন হীরা'র ২য় উপন্যাস। প্রথমত পূর্বে আমি কোন বই পড়তে গেলে কে লিখেছে সেটা কিংবা বইটা কালজয়ী কিনা বা নতুন হলে গুড রিভিউ আছে কিনা তা বিবেচনায় রাখতাম। কিন্তু গত কিছু বছর আমি বেশ কিছু নতুন লেখকদের বই পড়েছি। বিষয়টা অনেকটা এরকম অন্ধের মতো...কিন্তু পড়া শেষে বেশ কিছু নবীনদের লেখা আমাকে আশ্চর্যজনক ভাবেই মুগ্ধ করেছে। ঠিক তেমনি মুগ্ধ করেছে ‘এ শহরে’।

মূলগল্প: সামাজিক জীবনমুখী একটি উপন্যাস ‘এই শহরে’। শহরের সুন্দর পৌঢ় বাড়িকে ঘিরে উপন্যাস।বাড়িকে ঘিরে বললে ভুল হবে,বাড়ির মানুষদের ঘিরে। গল্পের বিষয়টা এভাবে প্রকাশ করা যায়- মানুষ দেখতে যতটা সুন্দর, আদতে মানুষ কি ততটা সুখী থাকে?

গল্পের মূল চরিত্র আনু। মাথায় টিউমারধারী, হুট করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অনিশ্চিত জীবন টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে যাওয়া এক তরুণী। বাবা সোবহান, মা হাজেরা এবং পাঁচ ভাই বোনের এক পরিবারের বাস স্বপ্নকুঠি নামে এক সুন্দর দোতালা বাড়িতে। কিন্তু পদ্মার করালগ্রাস ও ম্যানেজারের মাদক কারবারির কারণে মূল ব্যবসা দুটো চালের আড়ত হারান সোবহান সাহেব।গল্পে তাকে এক উদাসীন, দায়িত্ব জ্ঞানহীন মানুষ হিসেবে দেখা যায়। পরিবারের অন্যান্য চাহিদা ছাড়াও মেয়ে আনুর ব্রেণের চিকিৎসার কোন খোঁজ পর্যন্ত রাখেন না তিনি। মা হাজেরা বেগমকেই দেখা যায় জীবনের শেষ পর্যন্ত ছেলে মেয়েদের আগলে রাখার এক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে। আনু অসুস্থ হলেও এক পার্কে কাজ করে সংসারে কিছুটা সাহায্য করে।শুধু আনু না, ছোট ভাই সিনহা বাদে পরিবারে সবাই যে যার মতো টুকটাক কাজ করে। তবে সবচেয়ে ব্যস্ততম ছিলো অহনা।

গল্পে আনু চাইতো না তার এই অসুস্থ জীবনে কেউ আসুক।তবুও নবীন নামের এক উড়নচণ্ডী ছেলের সাথে এক শক্ত শিকলে বাঁধা পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত এই শিকল জুড়ে থাকে না। একদিন হুট করে ছোট বোন দিপা পালিয়ে বিয়ে করে।শানু বিয়ে হয়। কিন্তু আনুর আর বিয়ে করা হয় না। যদিও তার একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিলো মৃত্যুর আগে অন্তত বিয়ে করা।

“প্রেম থাকে টেবিলে, এঁটো করা ভাতের প্লেটে
মিশে থাকে কলমে আর কবিতার খাতায়”

এমনি সময়ের পাগলা ঘোড়ায় রাসেলের মাধ্যমে সবুজ নামের এক ছেলে আনুদের বাসায় আসে। পরিচয় হয় এবং বেশ কিছুদিনের ভালো লাগার পর হাজেরা বেগমের মতে আনুর সাথে বিয়েও হয়। কিন্তু বিয়েতেই কি সব। দুঃখ যার কপালে লিখা তার জন্য সুখ ভাগ করে নিতে কে বা আসে? বিয়ের চারদিন পর থেকেই সবুজের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। একসময় মা হাজেরাও চরম অসুস্থ হয় তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে ডাক্তার ব্রেণ অপারেশন করতে হবে জানায়। সব ভাই বোন মিলে গ্রামের শেষ ভিটে বিক্রি করে মায়ের অপারেশন করায় কিন্তু আশার বাক্য আর কিছু থাকে না। মা হারানোর পর থেকে সবচেয়ে একাকী হয়ে পড়ে আনু।কেননা অন্যান্য বোনদের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে আর অহনারও অনিকেতের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। এই নিষ্টুর একাকী জীবনে এবার একটা বিরতি চায় আনু...

পাঠক অনুভতি: গল্প বলার ধরন ছিলো একদম বাস্তবিক। ঠিক ততটা বাস্তবিক যতটা হলে প্রতিটা চরিত্র চোখের সামনে থেকে দেখা যায়,তাদের সুখ-দুঃখ অনুভব করা যায়। গল্পের শুরুতে সোবহান সাহেবকে কর্মঠ মনে হয়েছিলো কিন্তু শেষে তাকে গো-গোবিন্দ ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না।পাঁচ ভাই বোনের সংসারে প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা মানুষের সখ্যতার কারণে গল্পে অনেক চরিত্রে দেখা মেলে। এজন্য শুরুতে একটু প্যাঁচ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।তবে শেষে তা আর থাকে না।

ভাই বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমতি মনে হয়েছে অহনাকে। তার সম্ভাবনাময় পরিকল্পনা ও অন্যের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমার ভালো লেগেছে। এদিকে অহনার বন্ধু শ্যামল চরিত্রটা আনুদের পরিবারে জন্য সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তবে বিয়ের পর স্বামী জহির বিদেশ চলে গেলে মেজো বোন শানুর মতাদর্শ জঘন্য রকম ছিলো।মোটামুটি অন্যান্য চরিত্র গুলো ছিলো গল্পের সাথে একদম মানান সই। তবুও অহনার হবু স্বামী অনিকেত কে সুবিধা মনে হয়নি। গল্পকারও এখানে অনিকেত কে পুরোপুরি প্রকাশ করেনি।

হীরা ভাইয়ের লেখার মাঝে কবিতার ছলে কিছু বলার অভ্যাসটা বরাবরের মতোই সুন্দর ছিলো। ‘প্রতিবিম্বের অন্তরালে’ যেমন বেশ কিছু গান সংযুক্ত করেছিলেন ঠিক এটাতেও বেশ কবিতা জুড়ে দিয়েছেন। যা উপন্যাসটিকে আরো সাবলীল পাঠ্য করে প্রতিটা চরিত্রে জীবন যুদ্ধের দুঃখ গুলো নিজের করে ভাবিয়েছে। ‘এই শহরে’ এভাবেই সুখ দুঃখ মিশে থাকে ঠিক যেমনি ভাবে-

“প্রেম থাকে চৌকাঠে, ঘরের ধুলোময় দেয়ালে
থাকে বারান্দায়, থাকে ঘরের কার্নিশে”

মন্তব্যসমূহ

  1. রিভিউটা চমৎকার লাগলো। এটা পড়ে পাঠকের বইটি নিয়ে আগ্রহ জাগবে এমনটাই আশা করি।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার গাঠনিক মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

_________________________________________________

এখানে প্রকাশিত সমস্ত লেখা 'রেদোয়ান আহমেদ' কর্তৃক সংগৃহীত। © ২০২১-২০২৫